ব্যবহারিক জীবনে স্বেচ্ছাসেবকদের পালনীয় কয়েকটি উপদেশ—

সঙ্ঘবদ্ধ হও

সঙ্ঘের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি সত্তার সম্যক বিকাশ ঘটে। সঙ্ঘে নির্ধারিত বিধি আন্তরিকতার সঙ্গে মেনে চল। সঙ্ঘে প্রচলিত কোন নিয়ম যদি তোমার বিবেচনায় অসঙ্গত বলে মনে হয় তাহলে সঙ্ঘের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে সেই নিয়ম পরিবর্তনের চেষ্টা কর। কিন্তু সঙ্ঘ ত্যাগ করো না। যদি তুমি সেই নিয়ম পরিবর্তন করতে না পার অর্থাৎ অধিক সংখ্যক সদস্য যদি সেই নিয়ম সঙ্গত বলে মনে করে তাহলে কিছুদিন ধৈর্য ধর। যদি নিয়মটি প্রকৃত অসঙ্গত হয় তা হলে তোমার সমর্থকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে। কিন্তু তাও যদি না হয় এবং তুমি নিজে যদি স্বস্তি বোধ না কর তাহলে সঙ্ঘ ত্যাগ কর। কিন্তু সঙ্ঘে যতদিন থাকবে কিংবা সঙ্ঘ ত্যাগের পর কোন অবস্থায় সঙ্ঘের ক্ষতিকর কিছু করো না। কারণ চরম সত্য কি তা কেউ জানে না। তুমি অভ্রান্ত এমন দত্ত না থাকা ভাল।

ধৈর্যশীল হও। সহিষ্ণু হও

                      ধৈর্য একটি পরম গুণ। অপরের কথা ধৈর্য ধরে শোন। কোন কিছু করার জন্য তোমার মনের (বিবেকের) সমর্থন না পাওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধর। বিপদের সময় দিশেহারা না হয়ে ধৈর্য ধরে অবস্থাটা পর্যালোচনা করে কর্মপন্থা ঠিক কর। ধৈর্য কর্মে বিলম্ব ঘটায় না। ধৈর্য তোমাকে সঠিক পথের নিশানা দেয়। আবেগকে সংযত করার জন্য ধৈর্যের অনুশীলন প্রত্যেকের পক্ষে প্রয়োজনীয়। 

                     ধৈর্য যেমন মানসিক সংযম, সহিষ্ণুতা তেমনি দৈহিক সংযম। মানসিক কষ্টের থেকেও দৈহিক কষ্ট আমাদের বেশি বিচলিত করে। গরমে বা শীতে কষ্ট হয়। ক্ষিদে পেলে কষ্ট হয়। ভারি কোন কিছু বইতে গেলে কষ্ট হয়। অনেকক্ষণ এক জায়গায় বসে থাকতে কষ্ট হয়। ঘুম না হলে কষ্ট হয়। শরীরে আঘাত পেলে কষ্ট হয়। কিছুটা অনুশীলন করলে এবং বিষয়টার প্রতি সচেতন থাকলে আমরা অনেক কিছু সহ্য করতে পারি। ধৈর্যশীলেরা অধিকতর সহিষ্ণু হতে পারে।

সত্যবাদী হও

                    প্রথমে তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে তুমি প্রায়ই মিথ্যা বল না। কখনো সখনো মিথ্যা বল। তুমি যত বড় মিথ্যাবাদী হও, হাজারটা কথায় একটা মিথ্যা বলাও তোমার পক্ষে সম্ভব নয়।

                   তুমি যখন বিশ্বাস করবে তুমি অর্তি কম মিথ্যা বল তখন সত্যবাদী হওয়ার সাহস পারে। সকলে সত্যবাদী হতে চায়। কিন্তু জানে না যে সকলে মূলত সত্যবাদী। দু-একটি অপ্রয়োজনীয় মিথ্যা বর্জন করলে প্রত্যেকে প্রায় সত্যবাদী হয়ে যাবে। বাকি নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যে মিথ্যা সেই সব মিথ্যা থেকে অব্যাহতি পেতে হলে স্বভাবের পরিবর্তন প্রয়োজন। 

                   স্বার্থসিদ্ধির জন্য মানুষ কিছু অপকর্ম করে। সেই অন্যায়কে গোপন করার জন্য তাকে মিথ্যাচারের আশ্রয় নিতে হয়। খারাপ কাজ যদি সে না করে তাহলে গোপন করার জন্য তাকে মিথ্যাও বলতে হয় না। 

                       মূল কথা হল 'সত্যবাদী হও এটা কেন উপদেশই নয়। বরং বলা যেতে পারে সদাচারী হও। সদাচারী মানুষের মিথ্যা বলার প্রয়োজনই হয় না। অতত্রব পরামর্শ হল এমন কিছু করো না যাকে গোপন করতে হয়। যদি করেই ফেল ভবিষ্যতে আর না করার শপথ নাও। যা করেছ তার জন্য যদি অনুতপ্ত হও কিংবা সম্ভব হলে তা যদি প্রকাশ করে দিতে পার তাহলে গ্লানি মুক্ত হবে।

বিনয়ী হও

                     তুমি কি কি জান তার হিসেব যদি কর তাহলে তুমি নিজেকে মহা পণ্ডিত ভাববে। আর তুমি যা যা জানো না তার হিসেব যদি করতে পার তাহলেই তুমি হবে জ্ঞানী। পাণ্ডিত্য অহংকারী করে তোলে আর জ্ঞান বিনয়ী করে। 

                     তোমার যা যা আছে কেবল যদি তার হিসেব কর তাহলে তোমার মনে দম্ভ  দেখা দিতে পারে। কিন্তু কি. কি তোমার নেই তার হিসেব যদি তুমি করতেপার তাহলে তোমার একটা তুচ্ছতার উপলব্ধি হবে এবং স্বাভাবিকভাবে তুমি বিনয়ী হবে। নির্বোধেরাই অহংকারী হয়, দুর্বিনীত হয়। বিনয়ে অতি সহজে কার্যোদ্ধার করা যায়। ঔদ্ধত্য শত্রু বৃদ্ধি করে। বিনয়ে মানুষ সহজে বশ হয়।

শিষ্টাচারী হও

                           কেউ তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলে সম্ভব হলে অর্থাৎ বসার ব্যবস্থা থাকলে বসতে বল। যদি তেমন ব্যবস্থা না থাকে, নিজে উঠে দাঁড়াও। তাঁর প্রয়োজন কি জানো। যদি তোমার পক্ষে তাঁর জন্য কিছু করা সম্ভব না হয় বিনীতভাবে তোমার অক্ষমতা প্রকাশ কর।

                           যিনি তোমার অনুগ্রহ প্রার্থনা করবেন অনেক সময় তা অযৌক্তিক মনে হবে। কোন কোন ক্ষেত্রে ভদ্রতার অভাব থাকতে পারে। তুমি তোমার মত আচরণ করবে। অন্যের অভদ্র ও অশিষ্ট আচরণ তোমাকে যেন অভদ্র করে না তোলে সে বিষয়ে সতর্ক থাকবে। 

                                  তোমার প্রয়োজনে অন্য কোথাও, কোন অফিসে, কিংবা কারো বাড়িতে তোমাকে যেতে হলে তুমি আগে নমস্কার করবে। তিনি যদি অধস্তন কর্মচারী হয়, কিংবা তুমি যদি উচ্চতর পদাধিকারী হও তাহলেও তুমিই আগে অভিবাদন জানাবে এবং তিনি না বসতে বললে বসবে না। টেবিলে হাত দিয়ে দাঁড়াবে না। 

                                     বয়স্করা মাথা নিচু করে প্রণাম করলে খুশি হন। এটি ভারতীয় শিষ্টাচারের অন্তর্গত। পায়ের ধূলো না নিয়েও মাথা নিচু করে প্রণাম করা যায়। 

                                     বাসে ট্রেনে শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থকে বসার জায়গা দিয়ে উঠে দাঁড়াবে। ভাববে তুমি বসার জায়গা পাওনি। এমন ত হামেশাই হয়। দানের ইচ্ছা আমাদের সকলের থাকে। কিন্তু সক্ষমতা থাকে না। এই সব ছোটখাটো ত্যাগের মধ্যে অপূর্ব এক আনন্দ পাবে। তোমার দান করার অপূর্ণ সাধও কিছুটা চরিতার্থ হবে। 

                                তোমার থেকে দৈহিক ক্ষমতা যার কম তার প্রতি কখনো শারীরিক নির্যাতন করবে না। বেড়াল বাচ্চা একটা বসে আছে। তাকে অকারণে লাথি দিয়ে ছুঁড়ে দেওয়া অনেকের বদঅভ্যাস আছে। অপেক্ষাকৃত কম দৈহিক শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিকে নির্যাতন না করার তত্ত্বটির মধ্যে একজন পুরুষ একজন স্ত্রীলোকের প্রতি কিরকম ব্যবহার করবে তার নির্দেশ রয়েছে। যেহেতু স্ত্রীলোকেরা তাপেক্ষাকৃত কম দৈহিক শক্তি সম্পন্ন তাই কোন পুরুষের পক্ষে স্ত্রীলোকের প্রতি দৈহিক নির্যাতন করা শিষ্টাচার বিরোধী। 

                     বয়স্কদের অনুমতি না নিয়ে তাঁদের সামনে সিগারেট খাবে না। তোমার দুই বন্ধুর সঙ্গে যদি কোন অবাঙ্গালী বন্ধু বেড়াতে যায় এবং সে যদি বাংলা না বোঝে তাহলে সে যতক্ষণ সঙ্গে থাকবে, তিনজনে বুঝতে পারবে এমন ভাষায় কথা বলবে। বাংলা বলো না। 

                        দু’জন লোক কথা বললে তুমি মাঝপথে তাঁদের কথার মধ্যে ঢুকে পড়ো না। প্রসঙ্গের জন্য অপেক্ষা কর। তাঁরা যে বিষয়ে কথা বলছেন সে বিষয় সম্পর্কে তোমার অভিমত না জানতে চাইলে আগ বাড়িয়ে দিও না। একই সঙ্গে চারজনে দু’টি বিষয়ে দু'জন দু'জন করে Cross কথাবার্তা বলো না। নিন্দা করো না।

নিন্দা করো না

নিজেকে বড় করার জন্য অপরের নিন্দে করা একটি প্রচলিত বদঅভ্যাস। এটি একটি চারিত্রিক দুর্বলতার লক্ষণ। খুব সচেতন ও সতর্ক না হলে এই দুর্বলতাটি অতিক্রম করা যায় না।

১। নিন্দায় সুখ নেই, প্রশংসায় সুখ। তুমি যখন কারো নিন্দা কর তখন আয়নায় তোমার মুখটা দেখো। মুখের চেহারাই তোমাকে বলে দেবে তোমার তখন সুখের অনুভূতি হচ্ছে না কষ্টের অনুভূতি হচ্ছে? অবশ্য নিন্দা করার মধ্যেও এক ধরনের সুখ আছে। সেই সুখটা অনেকটা দাদ জাতীয় চর্মরোগ চুলকানোর মত সুখ।

২। নিন্দা মানুষের মনকে ছোট করে।

৩। নিন্দার সঙ্গে মিথ্যার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ।

৪। নিন্দা তোমার ব্যক্তিগত অভিমত মাত্র। যার জন্ম তোমার ত্রুটিপূর্ণ পর্যবেক্ষণও হতে পারে।

                         কোন বস্তুর নিন্দে তুমি করতে পার না। তোমার পছন্দ না হলেও বস্তু নিন্দনীয় হতে পারে না। সুঁটকি মাছ সুঁটকি মাছই। তা তুমি যদি না পছন্দ কর খাবে না। তা বলে তার তুমি নিন্দেও করতে পার না। শুকনো মাছের ধর্ম শুকনো মাছে থাকবেই। লঙ্কা, তেলেভাজা, মাছ, মাংস, রসুন। অনেকেই অনেক কিছু খায় না। খাই না বলেই ‘বাজে'—নাক কুঁচকে নামগুলো উচ্চারণ করতে হবে---এটা কি ঠিক? 

                    কোন ব্যক্তিরও তুমি নিন্দে করতে পার না। যে লোককে তোমার পছন্দ হয় না তার কোন বন্ধু-বান্ধব নেই ভাবাটা বোকামি। আবার কোন একটা কারণে সেই ব্যক্তি সম্পর্কে তোমার মন্দ ধারণা হলেও এমন অনেক সময় দেখা যায় অন্য অবস্থায় সেই ব্যক্তির আচরণে তুমি মুগ্ধ হতে পার। 

                         সব কিছুকে কিংবা সব মানুষকে আমাদের ভাল লাগবে এমন হতে পারে না। তবে নিজের মন্দ লাগাকে ঘোষণা করে বেড়ানো, অন্যের ত্রুটিকে ফলাও করে প্রচার করার মধ্যে তোমার কোন লাভের সম্ভাবনা নেই। বরং ক্ষতিগ্রস্ত হতে পার। যার যা ভাল তাকে প্রকাশ কর। নিন্দা কুৎসা পরিহার কর।

সময়নিষ্ঠ হও

মানুষের কাজ অনেক, কিন্তু সময় কম। পরমায়ুকে ত টেনে বড় করা যাবে না। তবে চেষ্টা করলে তাকে দু গুণ করা যায়। সেই চেষ্টার নামই সময় নিষ্ঠা। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে যদি প্রাত্যহিক কর্মসূচীকে সংলগ্ন করতে পারা যায় তা হলে দেখা যাবে যত কাজ সাধারণত করা যায়, তার দ্বিগুণ কাজ করা সম্ভব। শৃঙ্খলার অন্যতম শর্তই হল সময়নিষ্ঠা। বিপন্নবন্ধুর প্রত্যেকস্বেচ্ছাসেবককে চেষ্টা করতে হবে যখন সভা আহ্বান করা হবে ঠিক সেই সময় যেন সভা আরম্ভ হয়। যখন কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা করা হবে ঠিক সেই সময় যেন সেখানে যাওয়া যায়। যে সময় যে কাজ করার কথা ঠিক সেই সময় যেন সেই কাজটি করা হয়। এই অভ্যাসটির সঠিক অনুশীলন হলে প্রত্যেকে লাভবান হবে। যথা সময়ে কোন কিছু করে ফেলার একটা বিশেষ তৃপ্তিও পাওয়া যায়। সময়নিষ্ঠার এটা হল নগদ পাওনা। অন্যলোক যথা সময়ে আসে না, এই অজুহাতে তুমি বিলম্ব করো না। তোমরা যদি যথা সময় যা করবার তাই করে যেতে পারো তাহলে তোমাদের দেখে অন্যে তা শিখবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল আমরা অপরের দেখে বদ অভ্যাসগুলি রপ্ত করি। নিজে ঠিক করে অন্যকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করি না।

বিপন্ন বন্ধুতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি নিষ্ঠার সঙ্গে পালিত হবে। এবংবিপন্নবন্ধুর স্বেচ্ছাসেবকগণ তাদের ব্যক্তি জীবনে এই অভ্যাসগুলির অনুশীলনকরবে।

১। বিপন্নবন্ধুর সভা সব সময় নির্দিষ্ট সময়ে আরম্ভ হবে। একজনসদস্য উপস্থিত থাকলেও সভা আরম্ভ হবে। পরে যাঁরা আসবেন তাঁরা যেনবুঝতে পারেন যে তাঁরা যথা সময়ে আসতে পারেন নি।

২। প্যারেডে কোন স্বেচ্ছাসেবক বিলম্ব করে এলে তাকে পৃথক লাইনে দাঁড়াতে হবে। যত বড়ই অফিসার হোন নিয়মের পরিবর্তন হবে না। রাজা মহারাজাদেরও সময়ের আনুগত্য স্বীকার করতে হয়।

৩। অর্থ সংগ্রহের সময় নির্দিষ্ট সময়সূচী অনুযায়ী যদি কোন স্বেচ্ছাসেবক উপস্থিত হতে না পারে তাহলে সেদিনের অর্থ সংগ্রহে তাকে সামিল করা হবে না। যত ক্ষতিই হোক, এ বিষয়ে কোন রকম আপস করা চলবে না।

৪। বিপন্নবন্ধুর যে কোন কর্মসূচী সূর্যোদয়ের মত যেন অনিবার্য হয়। প্রকৃতিতে যেমন নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা ও সময়নিষ্ঠা রয়েছে বিপন্নবন্ধুতেও যে কোন কাজ যেন অনুরূপ ভাবে সম্পাদিত হয়।

৫। মানুষ যন্ত্র নয়। বিপন্নবন্ধু তা স্বীকার করে। তাই কর্মসূচী প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবকদের স্বাধীনতা বিপন্নবন্ধুতে স্বীকৃত। যেমন আগামীকাল পাঁচটায় যাওয়া হবে না ছ'টায় যাওয়া হবে তা আলোচনা করে ঠিক করা যেতে পারে। তার পর যখন সময় নির্দিষ্ট হবে—তখনো যদি বিশেষ কোন স্বেচ্ছাসেবকের অসুবিধা থাকে তাহলে সে অক্ষমতা পূর্বাহ্ণেই জানিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু সকলে সম্মত হওয়ার পর সকলকে তা মেনে চলার ক্ষেত্রে স্বাধীনতার কোন স্থান বিপন্নবন্ধু স্বীকার করে না। সেক্ষেত্রে সে যান্ত্রিকতাতেই অধিকতর বিশ্বাসী। 

                     নিজেকে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে বেঁধে ফেল। তিনটা বাজলে ঘড়ির কাঁটাটি যেমন অনিবার্য ভাবে তিনটার ঘরে যায়, কাঁটাটি তিনটার ঘরে না পৌঁছানো পর্যন্ত যেমন তিনটা বাজে না তেমনি তিনটায় কোথাও যাবে বললে তোমাকেও অনুরূপভাবে গিয়ে পৌঁছাতে হবে। তুমি না যাওয়া পর্যন্ত যেন তিনটা না বাজতে পারে।

সাহায্য, ঋণ, ভিক্ষা

                          পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্কের উপর সমাজ জীবন গড়ে ওঠে। আমি কাউকে কিছু দেবোনা এবং কারো কাছ থেকে কিছু নেবোনা এমন মানসিকতাকে অনেকে আদর্শ বলে মনে করতে পারেন। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এর মত ভ্রান্ত ধারণা আর কিছু হতে পারে না। আমরা কেউ একা বাঁচতে পারি না। জ্ঞানে অজ্ঞানে আমাদের সহস্র লোকের সাহায্য গ্রহণ করতে হয়। অর্থমূল্যে যা আমরা গ্রহণ করি তার মধ্যে যে কোন সাহায্য থাকতে পারে এ কথা ভেবে দেখি নি। সবজি দোকানে সবজি কিনে আমি দেকানদারকে যেমন কৃতার্থ করিনি, তেমনি দোকানদারও সবজি অর্থমূল্যের বিনিময়ে দিয়ে আমাকে কৃতার্থ করে নি। এটি হল একটি দিক। অন্যদিকে সবজি কিনে আমি তাকে যেমন সাহায্য করেছি দোকান চালাতে, তেমনি সবজি বিক্রি করে সে আমাকে সাহায্য করেছে আমার স্বচ্ছন্দ জীবন যাত্রায়। অর্থ বিনিময়ের মাধ্যম ছাড়া কিছু না। আমার টাকা থাকলেই আমি সবজি পাই না। বাজারে সবজি থাকতে হয়। বাজারে সবজি থাকে না যদি কোন কৃষক তা না ফলায়। এমনি পারস্পরিক সাহায্যের একটা শৃঙ্খল রচিত হয়। আমরা প্রত্যেকে কোন না কোন বিষয়ে একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। আমাদের সাহায্য করতে হয়এবং সাহায্য গ্রহণ করতেও হয়। 

                     ঋণ ভিন্ন ধরনের সাহায্য। ঋণ দু'রকমের হয়। এক ধরনের ঋণ হল ব্যবসায়। অর্থাৎ কিছু দিয়ে কিছুদিন পরে তার বাবদ আসলের সঙ্গে বাড়তি কিছু অর্থাৎ সুদ গ্রহণ করা। আর এক ধরনের ঋণ হল অসুবিধায় পড়ে বন্ধু বান্ধবের কাছ থেকে যা গ্রহণ করা হয়। এই গ্রহণ করার সময়েই ফেরত দেবার একটা অঙ্গীকার যেমন থাকে সেই সঙ্গে ফেরৎ দেবার একটা সময়সীমাও থাকে। হয়ত বিষয়টি কাগজে কলমে লেখা থাকে না, এমন কি আলোচনা করেও কোন স্থির করা হয় না, তাহলেও দাতা ও গ্রহীতা দু'জনেই একটা সময় অনুমান করে নেয়। 

                এসব ঋণের ক্ষেত্রে গ্রহীতা ঋণ গ্রহণের সময় সুনিশ্চিত থাকেন যে ঋণটি তিনি যথা সময় ফেরত দেবেন। যদি তা না থাকে তাহলে তাঁর সেই আচরণকে এক কথায় অসদাচরণ বলা যাবে। আর যাঁরা আন্তরিকভাবে চাইবেন নির্দিষ্ট দিনে টাকাটি ফেরত দিতে তাঁরা যদি সেই সময়সীমার মধ্যে অর্থ সংগ্রহ না করতে পারেন তাহলে তাঁদের প্রথম কর্তব্য হবে ঋণদাতার কাছে গিয়ে নিজের অক্ষমতা জানানো এবং ঋণ শোধের পরবর্তী দিন স্থির করে নেওয়া। 

                  বাধ্য হয়েই মানুষকে ঋণ নিতে হয়। তাই ঋণশোধ করার আগে ঋণীর বিন্দুমাত্র বিলাসিতার অবকাশ থাকে না। ঋণ শোধের আগে ঋণীর ভাল কিছু খাওয়া উচিত নয়, ভাল কিছু পরা উচিত নয় বা কাউকে কিছু উপঢৌকন দেওয়া উচিত নয়। কারণ কার টাকায় সে এসব করবে? পরের টাকায় নিশ্চয় কেউ বিলাসিতা করতে পারে না।

                   তাছাড়া মানুষকে অজস্রভাবে অন্যের অনুগ্রহ লাভ করতে হয়। সেই সব ঋণকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ রাখা এবং সুযোগ পেলে ঋণ স্বীকার করাই হল এই সব ঋণ পরিশোধের উপায়। 

                  তৃতীয় প্রকার সাহায্য গ্রহণ হল ভিক্ষা। গত্যন্তর না থাকলেই কেবল মানুষকে ভিক্ষা গ্রহণের মত আত্মাবমাননাকর পন্থা গ্রহণ করতে হয়। কোন সুস্থ লোকের এই পন্থা গ্রহণ করা অকর্তব্য! ভিক্ষা গ্রহণ একটি হীন বৃত্তি। ভিক্ষাগ্রহণ কারীর পরিশোধের বালাই থাকে না ঠিক, কিন্তু পরিশোধ করা যায় না বলে তার মেরুদণ্ডটিও আর সোজা হতে পারে না। কোন সুস্থ লোকের ভিক্ষাগ্রহণ কিংবা সুস্থ লোককে ভিক্ষা দান করা উভয়ই অনুচিত উপার্জনে অক্ষম বিকলাঙ্গ বা বৃদ্ধদের ভিক্ষা দেওয়া যেতে পারে। কারণ তাদের প্রতিপালন একটি সামাজিক কর্তব্য।

                বিপন্নবন্ধুর কোন স্বেচ্ছাসেবককে যদি কারো আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করতে হয় সে যেন সেটিকে পরিশোধ যোগ্য ঋণ হিসাবে গ্রহণ করে। সুযোগ পেলেই যেন সে সেই ঋণ শোধ করে দেয়। যদি সেদিন ঋণ দাতা জীবিত না থাকেন তাহলে তাঁর উত্তরাধিকারীকে তা না হলে অন্য কোন অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিকে সেই ঋণ সুদ সহ পরিশোধ করে। আমার নেই, তোমার আছে। আমার প্রয়োজন। অতএব তোমার কাছ থেকে আমি নিতে পারি। কিন্তু যখনই আমি সক্ষম হবো তখনই যেন আমি তোমাকে ফিরিয়ে দিতে পারি। বিপন্নবন্ধুর প্রতিটি স্বেচ্ছাসেবক এই বিষয়ে যেন দৃঢ় সঙ্কল্প হয়।

অহংকারী হও

অহংকার শব্দটি প্রায় দম্ভ অর্থে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু দম্ভ ও অহংকার সমার্থক নয়। ব্যক্তি নিজেকে সে যা নয় তার থেকে বিশাল কিছু বলে যখন প্রকাশ করে তখন তাকে দম্ভ বলে। আর ব্যক্তি সত্তার উপলব্ধির নাম অহংকার। তুমি একজন মানুষ। মানুষের প্রাপ্য সম্মান তোমারও পাওয়ার অধিকার আছে। নিজেকে কখনো অসম্মান করো না। বিনয় ভাল। কিন্তু নিজেকে অপদার্থ ভাবা বিনয় নয়—আত্মাবমাননা। জগতে তুচ্ছ বলে কিছু নেই। প্রত্যেকের নিজস্ব ভূমিকা আছে। সেখানে সে অনন্য। তোমার মধ্যেই সুন্দর বাস করেন। নিজেকে সুন্দর করে তোল।