বিপন্নবন্ধু ও নৈতিকতা

নৈতিকতাটা একটি জটিল ও বিতর্কিত বিষয়। তাই কোন্ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিপন্নবন্ধু নৈতিকতাকে গ্রহণ করেছে, কেন সে একটি নৈতিক প্রতিষ্ঠান তার কিছুটা বিশ্লেষণ প্রয়োজন। কোন প্রতিষ্ঠান এমন কি বিশেষ কোন উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত সঙ্ঘ সমিতিও ন্যায়নীতি বর্জিত নয়। কিন্তু কেবল নৈতিকতা অনুশীলনের উদ্দেশ্যে যদি কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে তবে তার ব্যতিক্রমী চরিত্রটি ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

প্রাকৃতিক নিয়ম ও নৈতিক নিয়ম

                প্রকৃতির নিয়ম অমোঘ ও অলঙ্ঘ্য। প্রকৃতি এমনই এক ধ্রুব পদে বাঁধা যেখানে কোন ব্যতিক্রম বা বিচ্যুতি নেই। প্রকৃতি মানুষের অনেক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। তার এই নিয়ন্ত্রণের নির্দেশে বিনয় নেই। সে কোন কাজ করা উচিত কোন কাজ করা উচিত নয় এটাই মাত্র নির্দেশ করে তার কর্তব্য শেষ করে না। সে রক্তচক্ষু দিয়েই শাসন করে। প্রকৃতি বলে না খুব শীতের সময় লেপ গায়ে দেওয়া উচিত। সে হুকুম করে—–লেপ গায়ে দাও। আমরাও বাধ্য ছেলের মত হি হি করতে করতে লেপের তলায় ঢুকে পড়ি। অনুরূপভাবে প্রকৃতি তার সকল নির্দেশ আমাদের মানতে বাধ্য করে। আমাদের আচরণের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই প্রকৃতির খবরদারি আমাদের মানতে হয়। 

             প্রকৃতির মেজাজটাও বেশ পুলিশী। যদি কেউ তাকে আগ্রাহ্য করে তবে সে সঙ্গে সঙ্গে না হয় দুচার দিনের মধ্যে সে তার দণ্ড বিধান করে। কাউকে সে ক্ষমা করে না। প্রকৃতির নির্দেশ—আগুনে হাত দিও না। কেউ যদি তার এই নির্দেশ অমান্য করে সঙ্গে সঙ্গে হাত পুড়িয়ে সে তার ফল ভোগ করে। ঠাণ্ডাকে অগ্রাহ্য করলে সর্দি-কাশির দণ্ড ভোগ করি। রাত্রে না ঘুমিয়ে সিনেমা দেখলে পরের দিন মাথার যন্ত্রণায় কষ্ট পাই। মোট কথা প্রকৃতির নিয়মকে অমান্য করে রেহাই পাওয়ার উপায় নেই। নৈতিক নিয়মও প্রাকৃতিক নিয়মের মত অমোঘ ও অলঙ্ঘ্য। কিন্তু নৈতিক নিয়ম কিছুটা বিনয়ী। সে কেবল কি করা উচিত আর কি করা উচিত নির্দেশ করে। আর নৈতিক নিয়ম অমান্যকারীকেও সঙ্গে সঙ্গে কোন দণ্ড ভোগ করতে হয় না বলে সে সহজে তার অপরাধের মাত্রা বুঝতে পারে না। কিন্তু নৈতিক নিয়মের প্রতি বাধ্যতা রয়েছে মানুষের প্রকৃতিতে। তাই তাকে অতিক্রম করার সাধ্য মানুষের নেই!

সামাজিক নিয়ম ও নৈতিক নিয়ম

              মানুষের কল্যাণের জন্য, উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য এবং সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যে সব নিয়ম প্রচলিত হয়, সেগুলিকে সামাজিক নিয়ম বলে। রাষ্ট্রনীতি, ধর্মনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি প্রভৃতি সামাজিক নিয়মের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। এই সব সামাজিক নিয়ম নৈতিকতাকে আশ্রয় করেই গড়ে ওঠে। প্রকৃত পক্ষে স্বতন্ত্র নৈতিক নিয়মের অস্তিত্ব আমরা সহজে বুঝতে পারি না। বিচ্যুতি ঘটলেই কেবল এই নিয়মের অস্তিত্ব টের পাই। সামাজিক নিয়মের সঙ্গে এই নিয়মের পার্থক্য হল এই নিয়ম মানুষের করা কোন নিয়ম নয়। আবার ঈশ্বর প্রবর্তিত কোন নিয়মও নয়। মানুষের স্বাভাবিক আচরণের মধ্যেই রয়েছে এর অস্তিত্বের প্রকাশ। 

             আমরা মনে করি বিশুদ্ধ নৈতিক নিয়মের কোন অস্তিত্ব নেই। সকল নৈতিক নিয়মের প্রকাশ ঘটে সামাজিক নিয়মের মধ্য দিয়ে। কারণ সমাজ জীবন ব্যতীত নৈতিক নিয়মের অস্তিত্ব অবাস্তব। ( আমাদের এই হঠাৎ কে ফেলা সিদ্ধান্ত সমালোচনার উর্দ্ধে নয়। কিন্তু যেহেতু এই লেখাটির উদ্দেশ তত্ত্ব-প্রতিষ্ঠা নয়, কোন সত্যে আমরা বিশ্বাসী তাই কেবল জানানো সেই জ তাত্ত্বিক আলোচনা সাধ্য মত পরিহার করা গেল )।

           ধরা যাক, সমাজ নেই। কেবল একটি মাত্র মানুষ আছে। সেই মানুষটির পক্ষে মিথ্যা কথা বলা, চুরি করা, ঘুষ নেওয়া, হত্যা করা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা, বিনা টিকিটে ট্রেনে বাসে চড়া, জাল ভোট দেওয়া প্রভৃতি সম্ভব হবে কি? তা যদি না হয়, তাহলে চুরি করো না, মিথ্যা বলো না জাতীয় নির্দেশের কোন অর্থই থাকে না। সমাজ জীবনেই এগুলি করার অবকাশ থাকে। এবং করলে সমাজের ক্ষতি হয়। তাই এগুলি না করার নির্দেশের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। 

          দেখা গেল, প্রচলিত তথাকথিত নৈতিক নিয়মগুলি প্রকৃতপক্ষে সামাজি নিয়ম। সমাজ জীবনের একটি স্তর আমরা কল্পনা করতে পারি যখন মানুষ  তার স্বভাব অনুযায়ী কাজ করত। ভাবের আদান প্রদানের জন্য মানুষ বলত। এবং স্বাভাবিক ভাবে তা সত্য হত। নিজের ইচ্ছা গোপন অন্যরকম কথা বলার ভণ্ডামি আদিম মানুষের জানা ছিল না। প্রতি ভঙ্গের সম্ভাবনা তখন ছিল না। কারণ প্রতিশ্রুতির ধারণাটাই এসেছে অ উন্নত স্তরে। যখন মিথ্যার সুবিধে মানুষ নিতে শিখে গেছে। কথা দিয়ে না রাখার সম্ভাবনা থাকলে তবেই ত প্রতিশ্রুতির প্রসঙ্গ ওঠে। ভেজাল দেও ঘুষ নেওয়া, প্রতারণা করা প্রভৃতি মনুষ্য চিন্তা বিকাশের উন্নততর স্তরে দিয়েছে। আদিম সমাজে এদের অস্তিত্ব ছিল না। 

         মানুষ বুদ্ধিবলে তার স্বভাব-বিরুদ্ধ এই আচরণগুলি এক সময় আবিষ্কার করেছে। অন্যান্য অনেক আবিষ্কারের মত এগুলিও হঠাৎ হঠাৎ এক এক সময় মানুষ আবিষ্কার করে ফেলেছে। তারপর অপরকে প্রতারিত করার এই কৌশলগুলিতে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির একটা আপাত সুফলও পেয়েছে। আবিষ্কার গুলির জনপ্রিয়তা লাভ করতেও বিলম্ব ঘটেনি। ফলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। আর তখনই সমাজকে রক্ষা করতে এই সব সামাজিক অনুশাসনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। চুরির প্রাদুর্ভাবে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে চুরি করা বন্ধের নির্দেশ সমাজকে দিতে হয়েছে। প্রথমের দিকে এই নির্দেশগুলির ভাষা কঠোর ছিল না। সেগুলি ছিল পরামর্শ জাতীয়। তাই এই নিষেধের ভাষা ছিল বিনীত। যেমন—চুরি করা উচিত নয়, মিথ্যে কথা বলা উচিত নয় প্রভৃতি। এগুলিই বর্তমানে নৈতিক নিয়ম নামে পরিচিত।

        এই ভাবে নিশ্চয় এই সব সমাজ বিরোধী আচরণকে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। তখন সামাজিক নির্দেশের সুর কঠোর থেকে কঠোরতর হয়েছে। নির্দেশ অমান্যকারীদের জন্য দণ্ডবিধানও করতে হয়েছে।

ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও নৈতিকতা

                      সামাজিক বিবর্তনের কোন স্তরে এসে এই সব অনৈতিক আচরণের উদ্ভব হয়েছে তা নির্ণয় করা খুব কঠিন নয়। এখন এটি গৃহীত সত্য যে মানুষের আদিম সমাজ ছিল অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণহীন। মানুষ একটি গোষ্ঠীতে দলবদ্ধ ভাবে বাস করত। তাদের কোন স্থায়ী বাসস্থান ছিল না। জীবন ধারণের প্রাথমিক শর্ত হল ক্ষুন্নিবৃত্তি। খাদ্যের প্রয়োজনে তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়াত। তখন মানুষের যা কিছু প্রয়োজন সব ছিল তাৎক্ষণিক। ভবিষ্যতের চিন্তা তাদের ছিল না। তাই তাদের সঞ্চয়ের ধারণাও ছিল না। যৌন জীবনে বাধাবন্ধের কোন কঠোরতা ছিল না। গোষ্ঠীর যে কোন তরুণ অন্যের সম্মতি সাপেক্ষে যে কোন তরুণীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে মিলিত হতে পারত। পিতৃত্ব নির্দিষ্ট ছিল না। শিশু গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে গৃহীত হত। 

                      উল্লিখিত সমাজ ব্যবস্থায় বর্তমানে প্রচলিত নৈতিক বিধির কোন প্রয়োজন থাকতে পারে না। চুরি করো না, প্রতারণা করো না কিংবা পরদার গমন করো না জাতীয় বিধি নিষেধ এই সমাজে অর্থহীন। 

                        কৃষির আবিষ্কার মনুষ্য সমাজ জীবনে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করল। মানুষের যাযাবর জীবন স্থিতি লাভ করল। সেই সঙ্গে পারিবারিক জীবন ও ব্যক্তিগত মালিকানা বোধের জন্ম হল। ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং বিশেষ একজন নারী বা পুরুষের উপর অধিকার যখন প্রতিষ্ঠিত হল, তখন বুদ্ধিমান মানুষ নিজ অধিকারের পরিধি যতদূর সম্ভব বিস্তৃত করার চেষ্টা করল। তার ফলে অপরের অধিকারের সীমারেখাকে সব সময় মান্য করা সম্ভব হল না। সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। সেই বিশৃঙ্খলা থেকে সমাজকে রক্ষা করার জন্য কিছু কিছু বিধি নিষেধের প্রয়োজন হল। প্রাচীনতম সামাজিক বিধি মনে হয়—মাতৃবৎ পরদারেষু পরদ্রব্যেষ্ণু লোষ্ট্রবৎ।

                 মানুষের জ্ঞানের পরিধি যত বিস্তৃত হয়েছে তার প্রয়োজনের তালিকাও সেই সঙ্গে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। নিজের স্বার্থ-সিদ্ধির জন্য মানুষ ততই অপরের স্বার্থ হানির কারণ হয়ে উঠেছে।

সব নৈতিক বিধি সামাজিক বিধি কিন্তু সব সামাজিক বিধি নৈতিকবিধি নয়।

                  পারিবারিক সম্পত্তি বৃদ্ধির প্রয়াস যখন পরধন গ্রাস করতে উদ্যত হল তখন সেগুলি নিয়ন্ত্রণের জন্য যে সব সামাজিক বিধি প্রণীত হয় সেগুলি ছিল সহজ স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। তার উপযোগিতা সকলে সহজে বুঝতে পারত। তাই সেই বিধিগুলি ছিল সৰ্ব্বজন স্বীকৃত। সেই সব বিধিকে মান্য করা পবিত্র কর্তব্য হিসেবে গণ্য হত। বিধিভঙ্গকারীকে সকলে ঘৃণা করত। আদিবাসী সমাজে সামাজিক বিধির প্রতি এই মনোভাব এখনো কিছুটা বর্তমান। 

                   এই বিধিগুলি কোন বিশেষ একজন মানুষের করা নয় কিংবা কোন এক দলের করা বিধি অন্যদের উপর চড়িয়ে দেওয়াও নয়। একটা বিশেষ সামাজিক অবস্থায় এই বিধিগুলি স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তাই ভিন্ন ভিন্ন সমাজেও এই নীতিগুলির অভিন্ন উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তারপর সামাজিক পরিস্থিতির কত পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সেই অজস্র পরিবর্তনের মধ্যেও এই সব বিধি অপরিবর্তিত থেকে গেছে। এককথায় বলা হয় এই সব বিধি দেশে কালে অভিন্ন। এই সব সামাজিক বিধিকে আমরা বিশুদ্ধ নৈতিক বিধি বলে মনে করি। 

                      কিন্তু সকল সামাজিক বিধিকে নৈতিক বিধি বলা যায় না। অনেক সময় সমাজে কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা কোন প্রভাবশালী গোষ্ঠী নিজস্বার্থ সিদ্ধির জন্য কিছু নিয়ম করে অন্যদের মানতে বাধ্য করে। এই সব বিধিকে অস্বীকার করার একটা প্রবণতা থাকে। সেগুলি স্বাভাবিকভাবে সব সমাজে একরকম হয় না। সমাজের প্রগতির ক্ষেত্রে এই সব নিয়ম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। সমাজ সংস্কারকেরা এই সব বিধি সংস্কার করে সমাজকে জঞ্জাল মুক্ত করেন।

                এই আলোচনায় আমাদের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল নৈতিক বিধিগুলি ও সামাজিক বিধি। এইগুলিকে পালন করা আমাদের কর্তব্য-মাত্র নয় ( অর্থাৎ কর্তব্যটা এমন একটা বিষয় যা করা উচিত কিন্তু না করার স্বাধীনতা আমার আছে ) এই বিধিগুলি পালন করা আমাদের নিজেদের মঙ্গলের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়। আর এইসব বিধিকে মেনে না চলার আমাদের কোন স্বাধীনতাও নেই। আমরা সেই সব বিধিকে নৈতিক বিধি বলি যেগুলি অস্বীকার করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব।

নৈতিক নিয়মের বাধ্যবাধকতা

               নৈতিক নিয়ম মান্য করা কর্তব্য মাত্র নয়, নৈতিক নিয়ম মানতে আমরা বাধ্য। কারণ নৈতিক নিয়মের বিকল্প কিছু নেই। 

              সত্য কথা বলা উচিত——এটি একটি নৈতিক বিধি! এই বিধিটি মানতে আমরা বাধ্য। আমরা মিথ্যা কথা বলতে পারি না। আমরা আগেই বলেছি সত্যকথা বলা সহজ, স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। এবং সেই জন্যেই আমরা সত্য কথা বলতে বাধ্য। 

                ধরা যাক আমরা সকলে মিথ্যে কথা বলছি। অবস্থাটা এখন কেমন দাঁড়াবে? আমি আমার স্ত্রীকে এক গ্লাস জল চাইবো। মিথ্যা বলে কিভাবে চাইবো? তখন আমাকে জল ছাড়া অন্য কিছু চাইতে হবে। দুধ চা, বই, খাতা, পাহাড়, সমুদ্র যা খুশি একটা কিছু বলতে হবে। তার থেকে আমার স্ত্রী কি বুঝবেন? আমি যদি চা চাই তিনি বুঝবেন আমি চা চাইছি না, কারণ আমি মিথ্যা বলছি। কিন্তু তিনি দেবেনটা কি? চা নয় বোঝালে জল বোঝায় না। অ চা বলতে চা ছাড়া পৃথিবীর তাবৎ কিছুকে বোঝায়। এটা ওটা দিতে দিতে দৈবাৎ যদি জল দিয়ে ফেলেন সেটা অন্য কথা। কিন্তু না পাওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশি। কারণ সত্য এক। সত্য ধ্রুব। অসত্য বহু। অসত্য অনির্দিষ্ট। সত্য কথার সাহায্যে মনের ভাব প্রকাশ করা সহজ ও স্বাভাবিক। আমাদের প্রাত্যহিক জীবন যাপনে, আমাদের সকল কাজ কর্মে, আমাদের চিন্তায় ভাবনায় সত্য কথা বলতে আমরা বাধ্য। সকল নৈতিক নিয়মগুলি বিশ্লেষণ করে এইভাবে নৈতিক নিয়মের বাধ্যবাধকতা প্রমাণ করা যায়।

সিদ্ধান্ত

এতক্ষণ ধরে আমরা যে বিষয়ে আলোচনা করলাম তার থেকে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তগুলি করতে পারি।

১। নৈতিক নিয়ম সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক নিয়ম। অন্য সামাজিক বিধি সমাজ ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। এক কালের সামাজিক বিধি পরবর্তীকালে পরিবর্তিত হতে পারে। কিন্তু যে সামাজিক বিধিগুলিকে আমরা নৈতিক বিধি আখ্যা দিয়েছি সেগুলি দেশে কালে অভিন্ন। সকল সমাজে সেই বিধিগুলি স্বীকৃত। এবং কোন সময়ে তাদের পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় না।

২। নৈতিক বিধি আমাদের যে সব আচরণ করতে বাধা দেয় সেগুলি মানুষের স্বাভাবিক আচরণ নয়। নৈতিক বিধি সন্মত আচরণগুলি স্বাভাবিক এবং যেহেতু স্বাভাবিক তাই সেগুলি সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত। নৈতিক বিধিসম্মত আচরণগুলি স্বাভাবিক বলে সেই আচরণের জন্য কেউ প্রশংসা দাবি করে না। কিন্তু নীতিবিরুদ্ধ আচরণের জন্য নিন্দে করা হয়। কেউ খুন না করলে, লোকে তাকে খুন করে নি, খুন করে নি বলে প্রশংসা করে বেড়ায় না। বরং যদি কেউ খুন করে তবে সে নিন্দিত হয়। সত্য কথনে প্রশংসার কিছু নেই, মিথ্যা বলাই অপরাধ। যা কিছু স্বাভাবিক সেই সব কিছু নিন্দা প্রশংসার ঊর্দ্ধে। তেঁতুল টক হলে তার নিন্দে হয় না। ল্যাংড়া আম টক হলেই ঝামেলা।

৩। সমাজের সকল ব্যক্তি যদি বিধি-সম্মত আচরণ করে তা হলে ব্যক্তি তথা সমাজের কল্যাণ হয়। সামাজিক প্রগতি অব্যাহত থাকে।

৪। নৈতিক বিধি অনুশীলনের দ্বারা ব্যক্তি নূতন কিছু লাভ করে না। অর্থাৎ নীতিসম্মত আচরণ করলে সততা বা সাধুতা অর্জন করা যায় না। এই অনুশীলনের দ্বারা মানুষের সততা ও সাধুতা রক্ষিত হয়। মানুষ স্বভাবতঃ সৎ। অসততা, মিথ্যাচার, প্রতারণা, পরধন গৃরুতা মানুষের অর্জিত গুণ। স্বভাব বিরোধী আচরণের ফলেই মানুষ এই সব অসৎ গুণ লাভ করে। তাই সৎ হও’ একটি অর্থহীন উপদেশ। বরং বলা যেতে পারে সৎ থেকো, কিংবা অসৎ হবে না। মানুষ যা আছে তাই থাকলেই সৎ থাকা হয়। অস্বাভাবিক আচরণই অসদাচারণ। সেই সব আচরণ না করার নির্দেশই হল নৈতিক বিধি। সেই জন্য নৈতিক নির্দেশগুলি না ধৰ্মী বা নেতিবাচক। মিথ্যা বলো না, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করো না, প্রতারণা করো না প্রভৃতি এই সব বিধির অনেক গুলিকে সদর্থক রূপে প্রকাশ করার ভাষাও নেই। 'খুন করো না’ বিধিটি সদর্থক রূপ কি হবে?

৫। নৈতিক বিচারের জন্য কোন তত্ত্বের প্রয়োজন নেই। কোন কাজটা ভাল আর কোন কাজটা মন্দ কর্তা নিজেই তা সহজে স্থির করতে পারে। স্বাভাবিক কাজ সহজে করা যায়। সেই কাজ করে কোন অস্বস্তি হয় না। কোন অস্বাভাবিক কাজ করা অধিকতর জটিল এবং সেই কাজের সময় ব্যক্তি অস্বস্তি বোধ করে। সত্য কথা সহজে বলা যায়। বলেও কোন অস্বস্তি থাকে না। মিথ্যে বলার ঝামেলা অনেক। মিথ্যে নির্বাচন করতে চিন্তা ভাবনা করতে হয়। সত্য ব্যতীত তাবৎ কিছু থেকে একটা মাত্র বিষয়কে নির্বাচন করা ত খুব সহজ কাজ নয়। তারপর মিথ্যা বলার একটা অস্বস্তি আছে। এই বিষয়টাকে সহজে প্রকাশ করার জন্য বলা হয় যা বিবেক সম্মত তাই ভাল। যে ক্রিয়ার পর বিবেকের দংশন ভোগ করতে হয় তাই মন্দ।

      ব্যক্তির বিচারে যদি ভুল হয়, তার সহজ ও স্বাভাবিক ক্রিয়া যদি অসঙ্গত হয়—তাহ’লেও চিন্তার কিছু নেই। সেটা হবে কোটিতে গুটি মাত্র। সেটুকু অনিচ্ছাকৃত অন্যায়ের কোন প্রভাব সমাজের উপর পড়ার কথা নয়।

৬। মানুষ স্বভাবতঃ স্বার্থপর। নিজের স্বার্থের জন্য সে কাজ অবশ্যই করবে এবং সেটাই স্বাভাবিক। কোন নৈতিক বিধি বলে না তোমার স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে কেবল অন্যের স্বার্থ দেখ। একজন মাত্র ব্যক্তির স্বার্থ সিদ্ধির উপায় যদি আমার থাকে তাহলে সেই একজন অবশ্যই আমি। আমাকে বাদ দিয়ে অন্যের জন্য করতে গেলেও ত সেই এক জনই উপকৃত হবে। তবে কোনটা স্বাভাবিক? নিজের করা না অন্যের? 

            কিন্তু আমি কেবল আমার কথা ভেবেই তৃপ্ত থাকতে পারি না। আমি যত ছোট মাপের মানুষ হই. আমার দৃষ্টিভঙ্গি যতই সংকীর্ণ হোক, তবু আমাকে অন্যের কথা ভাবতেই হয়। আমাকে আমার মা বাবার কথা ভাবতে হয়, স্ত্রী পুত্র কন্যার কথা ভাবতে হয়, আত্মীয় স্বজনদের কথা ভাবতে হয়, বন্ধু- বান্ধবদের কথা ভাবতে হয়। প্রতিবেশীদের কথা ভাবতে হয়। এমনি করে প্রত্যেকের একটা নিজস্ব জগৎ গড়ে ওঠে। যে যত বেশি ধী-শক্তি সম্পন্ন হয় তার জগৎ তত বিস্তৃত হয়। মহামানবদের জগৎ হয় বিশ্বজোড়া।

          অতএব আমরা যত নগণ্য হইনা কেন আমাদের প্রত্যেকের আত্মীয় পরিচিতদের নিয়ে একটি জগৎ আছে। আমি যাই করিনা কেন তার প্রভাব সীমাবদ্ধ থাকবে আমার নিজস্ব জগতে। তাই আমি যা করবো তা অবশ্যই নিজের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে করবো, কিন্তু অন্যের স্বার্থ হানি হোক এমন কোন কিছু আমি নিশ্চয় করবো না। যেমন আমি আমার স্বার্থ দেখতে গিয়ে আমার স্ত্রী বা আমার পুত্র কন্যার স্বার্থ হানিকর কিছু করতে পারিনা। কারণ তা স্বাভাবিক নয়। আমার স্বার্থ স্ত্রী-পুত্র-কন্যার স্বার্থের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। আমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা কিংবা আত্মীয় পরিচিতদের কাঁদিয়ে আমার সুখ আমি কামনা করতে পারি না। কারণ তেমন সুখ পাওয়া সম্ভবই নয়। সবার সুখের মধ্যেই ত আমার সুখের পূর্ণতা। 

           তাই মানুষের স্বভাবে যতই স্বার্থপরতা থাকুক কেবলমাত্র ব্যক্তি স্বার্থের মধ্যে তার বাসনা আবদ্ধ থাকতে পারে না। তাকে নিজস্বার্থ-সিদ্ধির জন্যই গোষ্ঠী স্বার্থের চিন্তা করতে হয়। অনুশীলনের ফলে সমাজ চেতনা জাগ্রতহওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোষ্ঠীর পরিধি ও ব্যাপকতর হয়। সাধারণভাবে সমাজ সত্তার একটা বোধ চেষ্টা করলে সকলেই লাভ করতে পারে। যদিও এই চেতনা সকলের সমান হতে পারে না। সেই অসম্পূর্ণতা কোন ব্যক্তির অপরাধ হতে পারে না। সাধ্যাতিরিক্ত না করতে পারার জন্য কেউ অপরাধী হয় না। 

              প্রত্যেকের নিজস্ব জগতের মধ্যে যে সমাজ, সেই সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির যোগাযোগ হয় হার্দিক। সেই সমাজের বাইরে যে বৃহত্তর সমাজ তার সম্পর্কে ব্যক্তির কেবলমাত্র বৌদ্ধিক যোগ থাকে। সেই সমাজ সম্পর্কে ব্যক্তির হয় কোন চেতনা থাকে না, না হয় একটা অস্পষ্ট ধারণা থাকে। সেই সমাজ সম্পর্কে তার কর্তব্য বোধও অস্পষ্ট হয়। ব্যক্তির নিজস্ব জগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ যে সমাজ, সেই সমাজেই যদি ব্যক্তি তার নৈতিক বিধিগুলি পালন করতে পারে তাহলেই তার স্বাভাবিক কর্তব্য করা হয়। তার কাছে তার বেশি কেউ প্রত্যাশা করে না। সকলে যদি তার নিজস্ব জগতের মধ্যে নিজ নিজ কর্তব্য পালন করে তাহ'লেই তার সামাজিক দায়িত্ব পালন করা হয়। তা হ'লেই আমরা একটি প্রগতিশীল সুস্থ সমাজ লাভ করতে পারি। সেই সমাজের হার্দিক পরিমণ্ডলে ব্যক্তি তার আশা আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে পারে।