আমরা এতক্ষণ বলে আসছি ব্যক্তি তার নিজের ভাল কিসে হয় তাই ভাববে। সেই সঙ্গে বলেছি অন্যের ক্ষতি যাতে না হয় তাও দেখবে। নিজের ভালো চাইতে চাইতে এক ধরনের অন্ধ স্বার্থপরতার শিকার হতে হয়। প্রত্যেককে সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। এই প্রসঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক ও সেবিকাদের কয়েকটি বিষয় ভেবে দেখার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তোমরা কি ভেবে দেখেছ—

১। জনসংখ্যা বিপজ্জনক ভাবে বেড়েছে বলে যখন তুমি বল, তখন কি নিজেকে তোমার বর্ধিত জনসংখ্যার একজন মনে হয়?

২। তুমি যাকে পছন্দ কর না সেও তোমাকে পছন্দ করে না। প্রত্যেকের পছন্দ করার অধিকার আছে। তুমি তোমার পছন্দকে যে গুরুত্ব দাও, তোমাকে যে পছন্দ করে না তার পছন্দকে কি সেই গুরুত্ব দাও?

৩। কোন একটি বিষয় নিয়ে তোমার সঙ্গে অন্য কারো মতান্তর হলে তোমার মতটাও যে ভুল হতে পারে একথা কি খেয়াল রাখ?

৪। তুমি যখন অন্যকে অভিযুক্ত কর—‘আপনি আমার কথা বুঝছেন না’ তখন তুমি কি একবারও ভেবে দেখ তাঁর কথাও তোমার না বোঝার সম্ভাবনা আছে?

৫। বেশির ভাগ ঝগড়া মানে ভুল বোঝাবুঝি। এই ভুল বোঝার দায় কি তুমি সবসময় অন্যের উপর চড়িয়ে দাও না?

৬। তোমার প্রত্যাশা মত অন্য জন ব্যবহার না করলে তুমি অসন্তুষ্ট হও। একবারও কি ভেবে দেখেছ তোমার ব্যবহার তাঁর প্রত্যাশা মত হয়েছিল কিনা?

৭। খুব ভিড় বাসে অতিষ্ঠ হয়ে যখন তুমি কণ্ডাক্টারকে গালাগালি কর তখন কি তুমি একবারও ভেবে দেখেছ যে বাসটি ভিড় হওয়ার জন্য প্রত্যেকের মত তুমিও সমান দায়ী?

৮। ঘুষ দিয়ে এসে ঘুষ নেওয়া কতটা অন্যায় তুমি যখন ব্যাখ্যা কর তখন কি ভেবে দেখেছ ঘুষ নেওয়ার পূর্ববর্তী ঘটনা হল ঘুষ দেওয়া। অপরাধটা আগে করে কে?

৯। অন্যকে যে অপরাধে তুমি অভিযুক্ত করছ সেই একই অপরাধে ক্ষেত্র বিশেষে তুমি অপরাধী নয়ত? 

              এই ধরনের চিন্তা ভাবনার ফলে তোমার প্রকৃত অবস্থানটা তুমি নির্ণয় করতে পারবে। তখন তুমি আবিষ্কার করতে পারবে তুমি কতকগুলি অভ্যস্ত ভ্রান্তির অনুসরণ করছ। তুমি সর্বদা নিজেকে বিচারকের আসনে বসিয়ে রেখেছ। তুমি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়া জিনিসগুলির গতির পরিমাপ করছ। বস্তুত তুমিও ত স্রোতে ভেসে চলেছ। নিজেকে স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে দেখ তোমার আগে দেখা বিষয়গুলির গতির সঙ্গে তোমার পার্থক্য এখন কতখানি। 

         আমরা প্রত্যেকে নিজেকে সব কিছুর কেন্দ্রে অবস্থিত ভাবতে অভ্যস্ত। সব কিছু যেন আমাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। আমার অসুবিধা সৃষ্টি করতেই আকাশে মেঘ করে, আমাকে যেদিন কোথাও যেতে হয় সেই দিনই বাস স্ট্রাইক হয়। আমাকে দেবার সময়ই পরিবেশকের হাতে মাছের পিসটা ছোট হয়ে যায়, আমার ছেলেকে নাম্বার দেবার সময় পরীক্ষকের যত কৃপণতা। এক কথায় বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে আমার ক্ষতি করার জন্য সকলে চক্রান্ত করে চলেছে। 

        যেমন আমরা ভাবি আমার মাথার উপর আকাশ আর আমার পায়ের নীচে পৃথিবী। সূর্য চন্দ্র গ্রহ নক্ষত্র আমাদের চার ধারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তোমার প্রকৃত অবস্থান জানতে হলে তোমার পৃথিবীকে আকাশে তুলে দাও। সেটা তখন শুক্র বা মঙ্গলের মত রাতের আকাশের একটা আলোক বিন্দু হয়ে যাবে। এখন তোমার মাথার উপর, পায়ের নীচে, ডাইনে বাঁয় আকাশ, আকাশ কেবল আকাশ। এখন আর তোমাকে কেন্দ্র করে কেউ ঘুরছে না। সকলের সঙ্গে তুমিও ঘুরে বেড়ােচ্ছ। এখন তোমার অন্যান্য গ্রহদের তোমার সগোত্র বলে মনে হবে। অহংকারে গড়া একাকীত্বের মিনার থেকে নেমে এসে তখন তুমি সবার সঙ্গে থাকার স্বস্তি বোধ করবে। 

           সমাজেও আমাদের অবস্থানটা ঐ রকম। একাকীত্বের গণ্ডি ভেঙ্গে পাঁচজনের একজন বলে তুমি যেদিন নিজেকে ভাবতে পারবে সেদিন তুমি তোমার সঠিক অবস্থানটি উপলব্ধি করতে পারবে। নিজের স্বার্থচিন্তার মধ্যেও কি করে অপরের মঙ্গল কামনা থাকতে পারে সেই বোধ জাগলেই তুমি একজন যথার্থ বিবেকবান ও দায়িত্বশীল নাগরিক হয়ে উঠবে।