যে কাজটিকে উপলক্ষ করে বিপন্নবন্ধু প্রতিষ্ঠিত তার নাম শুশ্রূষা। প্রাথমিক শুশ্রূষা কেন্দ্র হিসেবে বিপন্নবন্ধুর প্রথম পরিচিতি। গুরুতর অসুস্থ রোগীদের শুশ্রূষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা, রোগীকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা, ফ্রি-ক্লিনিক পরিচালনা, দুঃস্থ ও মেধাবী ছাত্রদের লেখাপড়ায় সাহায্য করা প্রভৃতি ক্রমে তার কার্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত হয়। এই সব কাজের মধ্য দিয়ে স্বেচ্ছাসেবক ও সেবিকাদের নীতিপরায়ণ নাগরিক করে গড়ে তোলার চেষ্টা করে বিপন্নবন্ধু। 

        বিপন্নবন্ধুর স্বেচ্ছা সেবক ও সেবিকাদের চারটি আদর্শ অনুশীলন করতে হয়। সেই চারটি আদর্শ হল সেবা, শৃঙ্খলা, সাহস ও সততা।

সেবা : সেবাপরায়ণতা মানুষের একটি স্বাভাবিক গুণ। অসুস্থ অসহায় মানুষদের জন্য কিছু করার তাগিদ রয়েছে মানুষের স্বভাবে। অপরিচিত কোন সহযাত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে একলা ফেলে রেখে নিজের কাজে, তা সে যত জরুরী কাজই হোক, চলে যেতে মানুষ অস্বস্তি বোধ করে। সঙ্গীহীন মানুষ তাই পথে ঘাটে প্রকৃত নিঃসঙ্গ বা নির্বান্ধব নয়। বিপদের সময় সহযোগিতার হাত একটি না একটি এগিয়ে আসেই। সকল মানুষের মধ্যে কম বেশি এই গুণটি বর্তমান। তাই দৃশ্যত রূঢ় ও নিষ্ঠুর ব্যক্তিদেরও কোন না কোন সময় সেবাপরায়ণ হয়ে উঠতে দেখা যায়। কিন্তু মানুষের স্বাভাবিক এই গুণটিকে সম্যক ভাবে বিকশিত করে তুলতে দীর্ঘ সাধনার প্রয়োজন হয়। বিপন্নবন্ধু স্বেচ্ছাসেবক ও সেবিকাদের সেই অনুশীলনের যথোচিত সুযোগ দিয়ে তাদের প্রকৃত সেবাপরায়ণ করে গড়ে তোলে।

শৃঙ্খলা : শৃঙ্খলাপরায়ণতা ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণের জন্য একটি অতিপ্রয়োজনীয় গুণ। মানুষ স্বভাবতঃ শৃঙ্খলাপরায়ণ না উচ্ছৃঙ্খল সে বিষয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কারণ প্রাণীমাত্রেই স্বাধীনতা প্রিয়। এবং শৃঙ্খলাকে অবাধ স্বাধীনতার পরিপন্থী মনে হতে পারে। সুতরাং সাধারণ ভাবে শৃঙ্খলাকে মানুষের স্বভাববিরোধী মনে হওয়াই স্বাভাবিক। 

           শৃঙ্খলার অন্য নাম নিয়মানুবর্তিতা। খাওয়ার সময় খাওয়া বা ঘুমের সময় ঘুমনোর নিয়ম অনুসরণ করতে কাউকে স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হয় না। অনেকগুলি থালা বাটি রান্না ঘরে যথেচ্ছ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলে তাকে গুছিয়ে রাখাই মানুষের স্বভাব। যে কোন অগোছানো জিনিস মানুষের অস্বস্তির কারণ হয়। বড়র উপর ছোট, তার উপর আরো ছোট পর পর এইভাবে থালা বাটি সাজিয়ে রাখার শিক্ষা কাউকে দিতে হয় না। এই গুছিয়ে রাখা অনেক রকম হতে পারে। অর্থাৎ তার বিভিন্ন ফর্ম থাকতে পারে। কিন্তু কোন না কোন—ফর্মেশান-এ জিনিসগুলিকে রাখার নামই হল গুছিয়ে রাখা। আমাদের গৃহ নির্মাণ বেড়া দেওয়া, বাগানে গাছ লাগানো সব কিছুর মধ্যে একটা ফর্মেশান বা প্যাটার্ণ থাকে। এই গুছিয়ে রাখার মধ্যে যেমন একটা মানসিক তৃপ্তির ব্যাপার আছে, তেমনি এর ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। গুছিয়ে রাখলে অল্প জায়গায় বেশি জিনিস রাখা সম্ভব।

        তেমনি শৃঙ্খলার সাহায্যে আমরা অল্প সময়ে এবং অল্প সংখ্যক লোকের সাহায্যে অনেক বেশি কাজ করতে পারি। মানুষ যদি বুঝতে পারে যে কোন নিয়ম অনুসরণ করলে সে উপকৃত হবে, তাহ'লে স্বেচ্ছায় সে সেই নিয়মের অনুবর্তী হয়। কেবল অন্যের আরোপিত নিয়ম মেনে চলার বাধ্যবাধকতার মধ্যে থাকে পরাধীনতার যন্ত্রণা। শৃঙ্খলার উপযোগিতা সহজে বোঝা যায় সঙ্ঘবদ্ধ কাজে। আমাদের অনেক কাজেই অনেককে মিলে করতে হয়। কোন একজনের পক্ষে সেই কাজ করা সম্ভব নয়। দশে মিলে যখন কাজ করতে হয় তখনই বোঝা যায় সুষ্ঠুভাবে কর্ম সম্পাদনে শৃঙ্খলা কত প্রয়োজনীয় পন্থা।

   বিপন্নবন্ধুতে শৃঙ্খলা পরায়ণতা অনুশীলনের সূচনা হয় দৈহিক প্রতিবর্ত গঠনের মধ্যে দিয়ে। স্বেচ্ছাসেবক ও সেবিকাদের ড্রিল করানো হয়। একসঙ্গে পা ফেলে হাঁটার তালে, সব পদক্ষেপ একসঙ্গে পড়ার শব্দে একটা সুখানুভূতি আছে। একসঙ্গে চিৎকার করে ধেয়ে যাওয়া মুহূর্তে দিক্-পরিবর্তন করে অন্যদিকে ছোটা, একসঙ্গে থমকে দাঁড়ানোর মধ্যে একটা বাড়তি শক্তির উপলব্ধি হয়। ব্যক্তিশক্তি তখন সমষ্টি শক্তিতে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। বুক টান টান করে দৃঢ় পদক্ষেপে যখন একজন সৈনিক হাঁটে তখন তার হাঁটার মধ্যে সমগ্র সৈন্যবাহিনীর শক্তি ভর করে। 

    ড্রিলে কেবল শরীরই মজবুত হয় না, শরীর ও মনের মধ্যে একটা সমন্বয় গড়ে ওঠে। তথাকথিত অনেক মানসিক ক্রিয়া তখন প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়ে কর্মক্ষমতা অনেক বেশি ক্ষিপ্র ও শাণিত হয়। ড্রিলের মাধ্যমে সমবেত ভাবে কোন কিছু করার আনন্দ যখন স্বেচ্ছাসেবকেরা পেতে থাকে তখন তাদের আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা চলে—কোন কাজ অল্প সময়ে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে হলে শৃঙ্খলার কত প্রয়োজন।

সাহস : মানুষ স্বভাবতঃ ভীরু না সাহসী এ সম্পর্কে সরাসরি কিছু বলা সম্ভব না হলেও সাহসিকতার সঙ্গে নৈতিকতার যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে,সে কথাটা সহজে প্রমাণ করা যায়। মানুষ শক্তিশালী হলেই সাহসী হয় না। ‘আমি কোন অন্যায় করিনি'—এই বিশ্বাস যার যত দৃঢ়, সে তত সাহসী। বিপরীত পক্ষে যে অপরাধী সে যতই শক্তিশালী হোক, ন্যায়নিষ্ঠ একটি মানুষের কাছে সে সঙ্কুচিত হয়ে পড়বেই। 

           আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাহসের প্রয়োজন। সেবার মত আপাত নিরীহ কাজটি করতেও যথেষ্ট সাহসের প্রয়োজন হয়। সংক্রামক রোগের সংক্রমণের আশঙ্কা, মুমূর্খ ও বিকারগ্রস্থ রোগীর বিভীষিকা, দুর্ঘটনায় বিকৃত দেহ রোগীর বীভৎসতার মুখোমুখী হতে গেলে যথেষ্ট সাহসের প্রয়োজন হয়। তাই রোগসংক্রমণের ভয়ে বলবান মানুষেরা যখন প্রাণ নিয়ে পালায়, তখন সেবা-পরায়ণ ক্ষীণ দেহ ব্যক্তি একলা সেই রোগীর শিয়রে বসে বিনিদ্র রজনী অতিবাহিত করে। 

       অসাধুতার হাতছানিকে উপেক্ষা করতেও সাহসের প্রয়োজন। সব কিছুকে ভয় করে সমস্ত অন্যায়ের মধ্যে নিজের গা বাঁচিয়ে চলার দুর্বলতা প্রকৃত পক্ষে আত্মাবমাননা। যে কোন অন্যায়ের প্রতিরোধ করা কোন এক জনের পক্ষে সম্ভব না হলেও প্রতিবাদ করা যায়। এবং তা করতে গেলে সাহসের প্রয়োজন হয়। প্রাত্যহিক জীবনের অজস্র সমস্যার মোকাবিলা করতে হয় মানুষকে। ভীরুরা ত মরার আগেই মরে। 

      শ্রাবস্তীপুরে যখন দুর্ভিক্ষ দেখা দিল, বুদ্ধ শহরের সকল ধনী ব্যক্তিদের আহ্বান করে বললেন--‘দরিদ্রের অন্নদান সেবা / তোমরা লইবে বল কেবা'। তখন সকল শেঠেরা মাথা হেঁট করে ছিল। একজন ভিখারিণী বুদ্ধদেবকে বলেছিল সে এই ভার নেবে। 'ভিক্ষা অন্নে বাঁচাব বসুধা। এটি ভিখারীর আস্ফালন নয়। পরম সাহসীর এক দৃপ্ত ঘোষণা। সদাচার মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। সদাচারের অনুশীলনই সাহসী হওয়ার পথ।

সততা:  সৎ হওয়াই বিপন্নবন্ধর স্বেচ্ছাসেবক ও সেবিকাদের চরম লক্ষ্য। সততা কথাটি প্রচলিত অর্থে বহু অর্থবোধক ও বিভ্রান্তিকর। আমরা সততার একটি সহজ সংজ্ঞা দিয়েছি। যা স্বাভাবিক তাই সৎ। কথাটির মধ্যে নৈতিক প্রকৃতিবাদের গন্ধ রয়েছে বলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীর একটু বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজন। 

         মানুষের স্বভাব হল সহজ সরল জটিলতা মুক্ত নির্ঝঞ্ঝাট জীবন যাপন করা। অসাধুতার মধ্যে আপাত লাভের সম্ভাবনা থাকলেও বিপদের ঝুঁকি থাকে। এ ধরনের কাজ মানুষের স্বভাববিরুদ্ধ বলে কাজ শেষ করার পর ব্যক্তি তার মানসিক স্বস্তি হারায়। সত্যকথা বলা অপেক্ষা মিথ্যা বলা অনেক কঠিন। তাই মিথ্যা ভাষণ মানুষের স্বভাব-বিরুদ্ধ। অনুরূপ ভাবে যে কোন অসাধুতাই মানুষের স্বভাব-বিরুদ্ধ তাই অস্বস্তিকর। মানুষ দায়ে না পড়লে এ ধরনের কাজ করে না। অবশ্য একই নিষিদ্ধ ক্রিয়া পুনঃ পুনঃ করার ফলে সেটা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়। এবং অস্বস্তিবোধটাও সহ্য হয়ে যায়। কিন্তু তা কখনো স্বাভাবিক কর্ম-সম্পাদনের তৃপ্তি দিতে পারে না। 

         মানুষ স্বভাবতঃ স্বার্থপর। নিজের স্বার্থ-সিদ্ধির জন্যই মানুষ কাজ করে। যে কাজে নিজের লাভের কোন সম্ভাবনা নেই সেই কাজে মানুষ উৎসাহ বোধ করে না। নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে অন্যের কল্যাণ সাধন করার পরামর্শ অবাস্তব বলেই আমাদের বিশ্বাস। ক্ষুধার সময় নিজে না খেয়ে অপরকে খাওয়ানোর মধ্যে হয়ত মহত্ব আছে কিন্তু স্বাভাবিকতা নেই। দুর্ভিক্ষের সময় ক্ষুধার্ত মা সন্তানকে খেতে না দিয়ে নিজে খাচ্ছেন এই দৃশ্য যতই মর্মান্তিক হোক এর মধ্যে সত্যের প্রকাশ আছে। যাঁরা বলেন ভোগ না করে ত্যাগ করা উচিত, তাঁরা অবশ্যই পণ্ডিত মানুষ কিন্তু কতটা বুদ্ধিমান তাতে সন্দেহ আছে। যদি কেউ তা করতে পারেন অবশ্যই আমরা তাঁর জয়ধ্বনি দেবো। কিন্তু আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ত্যাগের এই মহান আদর্শ সকলের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। আর তার প্রয়োজন আছে বলেও আমরা মনে করি না।

               নিজের স্বার্থ-সিদ্ধির প্রচেষ্টাকে বিপন্নবন্ধু মন্দ বলে না। বরং সে মনে করে প্রত্যেকের নিজের স্বার্থ দেখা উচিত। কারণ সেটাই স্বাভাবিক। একটা জিনিস আমাদের বিশ্বাস করতে হবে—আমি যেমন আমার স্বার্থ দেখবো, অন্যেরও নিজের স্বার্থ দেখার অধিকার আছে। আমার কাজে অন্যের স্বার্থ যাতে বিঘ্নিত না হয় সেদিকে আমার লক্ষ্য রাখতে হবে। তাই বিপন্নবন্ধুর সদাচারের সংজ্ঞা হল—যে কাজে নিজের মঙ্গল হয় কিন্তু অপরের অমঙ্গলের কোন আশঙ্কা থাকে না, সেই কাজ সৎ। 

            আমাদের নৈতিক আদর্শ ত্যাগের মহান আদর্শ অপেক্ষা নিকৃষ্ট হতে পারে এবং সততার সংজ্ঞাটিও তাত্ত্বিক আলোচনায় হয়ত অতি সরলীকরণ দোষদুষ্ট বলে প্রমাণিত হবে, কিন্তু বিপন্নবন্ধুর নৈতিক আদর্শ যে অধিকতর সহজবোধ্য ও সহজসাধ্য এ বিষয়ে আশা করা যায় সকলে একমত হবেন। এবং সেই সঙ্গে একথাটাও স্বীকার করবেন যে এই আদর্শ অনুসরণ করলে সমাজের অন্ততঃ কিছুটা কল্যাণ হবে। 

                    তর্কের জন্য বলা যেতে পারে, আমি যে কাজ করতে যাচ্ছি তাতে অপরের ক্ষতির আশঙ্কা আছে কি না কি করে বুঝবো? কার কোথায় কি ক্ষতি হবে তা ত আমার জানা নেই। তাছাড়া এখন হয়ত আমার কাজে অন্যের ক্ষতির আশঙ্কা নেই কিন্তু ভবিষ্যতে যে কারো ক্ষতি হবে না তার গ্যারান্টি কোথায়? 

                আমরা আবার বলছি আমরা আমাদের নৈতিক আদর্শের তাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা দাবি করছি না। কর্তা কর্ম-সম্পাদনের পূর্বে নিজের স্বাভাবিক বোধে যদি বোঝেন এই কাজটি করলে অপরের ক্ষতি হবে না তাহলেই তিনি সেই কাজ করতে পারেন। কোন চোর জানে না যে যার চুরি করা হচ্ছে তার ক্ষতি হবে? যে ভেজাল দেয় সেকি জানে না এতে অন্যের ক্ষতি করা হচ্ছে? মানুষ নিজে যেটাকে মন্দ বলে জানে, সেই কাজটা যদি সে না করে তাহলেই আমরা অনেকটা সুস্থ সমাজ পাবো।